ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন পদ্ধতি

ছাগল চরাচ্ছের আব্দুল গনি মিয়া ও তার স্ত্রী, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল।ছাগল চরাচ্ছের আব্দুল গনি মিয়া ও তার স্ত্রী, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন পদ্ধতি

দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ছাগল পালনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে। ছাগল ভূমিহীন কৃষক ও দুস্থ নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য উপায়। বিশেষ করে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য মোচনে ভূমিকা রাখতে পারে। লিখেছেন- কৃষিবিদ মোঃ নিয়ামুল কবীর

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ছাগলের গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় অর্থনীতিতে ছাগলের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ছাগল পালনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে। ছাগল ভূমিহীন কৃষক ও দুস্থ নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য উপায়। ছাগলের মাংস উন্নতমানের প্রাণিজ আমিষের উৎস। ছাগলের দুধ সহজে হজম হয়। আদিকাল থেকে গ্রামবাংলার নারীরা বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে ছাগল পালন করে আসছেন। তাই বলা যায়, ছাগল বিশেষ করে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য মোচনে ভূমিকা রাখতে পারে। ছাগল পালনের তেমন কোনো কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। ছোট প্রাণী, দাম কমÑ তাই প্রাথমিকভাবে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করা যায়। ছাগলের রোগবালাই তুলনামূলক কম। ১২ মাসে দু’বার বাচ্চা পাওয়া যায়। প্রতিবারে ১-৪টি বাচ্চা দেয়। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। চামড়া খুবই মূল্যবান, যা বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ছাগল লালন-পালন ও চিকিৎসা খরচ অন্যান্য পশুর তুলনায় অনেক কম।

ছাগলের জাত পরিচিতিঃ

পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতের ছাগল রয়েছে। বাংলাদেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল, যমুনাপারি, বারবারি জাতের ছাগল দেখা যায়। তবে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেশি উপযোগী। এদেশে কালো রঙের যে ছাগল পাওয়া যায় সেটি ব্ল্যাক বেঙ্গল বা বাংলার কালো ছাগল নামে পরিচিত। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল শুধু কালো রঙের হয় না। কালো রঙ ছাড়াও সাদা ও ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংসের চাহিদা রয়েছে সারা বিশ্বে।

ব্ল্যাক বেঙ্গল-দেশি জাতের ছাগলের বৈশিষ্ট্যঃ

আকারে ছোট কিন্তু মোটাসোটা ও একসঙ্গে দুই থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। গায়ের লোম ছোট ও মসৃণ।

পাঁঠার ওজন ২০ থেকে ৩০ কেজি। ছাগীর ওজন ১৫ থেকে ২৫ কেজি। খাসির ওজন ২০ থেকে ৩৫ কেজি।

ছাগীর শিং ছোট (৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার) এবং সরু ও ঊর্ধ্বমুখী। কিছু কিছু পাঁঠা ও ছাগীর দাঁড়ি থাকে।

কিন্তু পাঁঠার শিং তুলনামূলকভাবে বড় (১১ থেকে ১২ সেন্টিমিটার) মোটা এবং পেছনের দিকে বাঁকানো।

ছাগলের বাসস্থানঃ

ছাগল পালনের জন্য খুব উন্নতমানের বাসস্থানের প্রয়োজন হয় না। বাসস্থানের জন্য সাধারণ ব্যবস্থাই যথেষ্ট। ছাগল সাধারণত শুষ্ক আবহাওয়া, পরিষ্কার, দুর্গন্ধমুক্ত, উষ্ণ ও প্রচুর আলো-বাতাস চলাচলকারী পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। ভিজা স্যাঁতসেঁতে, গোবরযুক্ত, দুর্গন্ধময়, বদ্ধ ও অন্ধকার পরিবেশ ছাগলের রোগবালাইয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। নিউমোনিয়া, চর্মরোগ, ডায়রিয়া ইত্যাদি সংক্রামক ও পরজীবী রোগ হতে পারে। ফলে ছাগলের ওজন বৃদ্ধির হার, দুধের পরিমাণ এবং প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। আমাদের দেশে গ্রামেগঞ্জে সাধারণত পারিবারিক পর্যায়ে ছাগল পালন করা হয়ে থাকে, যার জন্য আলাদা বাসস্থানের বন্দোবস্ত করা হয় না। গোয়ালঘরের এক কোণে বা ঘরের বারান্দায়, রান্নাঘরের এক কোণে এমনকি নিজের শোয়ারঘরে রাতে ছাগল থাকার ব্যবস্থা করে থাকেন অনেকে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা ছাগলের জন্য আলাদা ঘর তৈরি করে থাকেন। এসব ঘর নির্দিষ্ট কোনো মাপে তৈরি করা হয় না। ছাগী, পাঁঠা, বাচ্চা একই ঘরে রাখা হয়। ছাগলের খামারের জন্য আলাদা ঘর তোলার সময় বিবেচনা করতে হয়Ñ

ঘরের আয়তন বা মাপঃ

একটি ছাগলের জন্য কমপক্ষে চারদিকে ১.৫ মিটার বর্গাকার জায়গা প্রয়োজন (১.৫ মিটারÍ১.৫ মিটার)। দোচালা বা চারচালা ঘর হলে দেয়াল কমপক্ষে ২ থেকে ২.৫ মিটার উচ্চতা হতে হবে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস যাতে ঘরে প্রবেশ করতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ছাগলের খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ

ছাগল প্রায় সব ধরনের লতাপাতা খেতে পছন্দ করে। সব সময় একই ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করে না। অন্য পশুর ফেলে দেয়া বা নোংরা করা খাবার ছাগল পছন্দ করে না। ছাগল মাঠে অতি ক্ষুদ্র ঘাসের মধ্যেও চরে খেতে পারে। কাঁঠালপাতা, কলাপাতা, ইপিল-ইপিলপাতা, পেয়ারাপাতা, বরইপাতা ছাগলের প্রিয় খাদ্য। ছাগলকে প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি তৈরিকৃত সুষম-দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।

ছাগলের বাচ্চাকে খাসিকরণঃ

ছাগলের বাচ্চার বয়স ২ থেকে ৪ সপ্তাহ অর্থাৎ ১৪ থেকে ২৮ দিন বয়সের মধ্যেই খাসি করানোর উপযুক্ত সময়। উপযুক্ত সময়ে ছাগলের বাচ্চাকে খাসিকরণ করা হলে তুলনামূলক দাম বেশি পাওয়া যায়। বাজারে খাসির চাহিদা বেশি। লগ্নিকৃত অর্থ লাভসহ সহজে উঠে আসে। পারিবারিক সচ্ছলতা আনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। খাসির মাংস পাঁঠার চেয়ে উৎকৃষ্ট। খাসিকরণে তেমন কোনো খরচ হয় না।

ছাগীকে পাল দেয়ার নিয়ম ও সময়ঃ

ছাগী গরম হওয়ার ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাল দিতে হয়। সকালে গরম হলে বিকালের মধ্যে পাল দিতে হবে। বিকালে গরম হলে পরদিন সকালের মধ্যে পাল দিতে হবে। সম্ভব হলে ১২ ঘণ্টা ও ২৪ ঘণ্টা সময়ের মাথায় দু’বার পাল দিতে হবে। পাল দেয়ার ৫ মাসের (১৪০ থেকে ১৫০ দিন) মধ্যে ছাগী সাধারণত বাচ্চা দেয়।

ছাগলের দাঁত দেখে বয়স নির্ণয়ঃ

অস্থায়ী-দুধের দাঁত সবগুলো থাকলে ছাগলের বয়স ১২ মাসের নিচে। মাঝের এক জোড়া স্থায়ী দাঁত উঠলে ছাগলের বয়স ১২ থেকে ১৫ মাস। দুই জোড়া স্থায়ী দাঁত উঠলে ছাগলের বয়স ১৬ থেকে ২৪ মাস। তিন জোড়া স্থায়ী দাঁত উঠলে ছাগলের বয়স ২৫ থেকে ৩৬ মাস। চার জোড়া স্থায়ী দাঁত উঠলে ছাগলের বয়স ৩৭ মাস থেকে ঊর্ধেŸ হবে।

ছাগলের পরিচর্যাঃ

প্রতিদিন দুপুরে ছাগলকে প্রয়োজনমতো টাটকা ও পরিষ্কার পানি পান করাতে হবে। ছোবড়া জাতীয় খাবার যেমনÑ ঘাস, লতাপাতা, শুঁটিজাতীয় গাছ দিতে হয়। ছাগলকে প্রতি বছর নিয়মিত দুই থেকে তিনবার কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। ছাগলকে নিয়মিত সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে।

পচা বা দুর্গন্ধযুক্ত বা নোংরা খাবার না দেয়া। বাসস্থান উঁচু, শুকনা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় তৈরি করতে হবে। নিয়মিত বাসস্থানের মেঝের মলমূত্র পরিষ্কার করা এবং মেঝেতে চুন ছড়িয়ে দিয়ে জীবাণু সংক্রমণ কমাতে হবে। মাঝে মাঝে পরিষ্কার পানি দিয়ে ছাগলের শরীর পরিষ্কার বা গোসল করিয়ে দেয়া।

বাংলাদেশে ছাগলের রোগ-ব্যাধিঃ

ছাগলের বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি হয়ে থাকে। তবে গবাদিপশু অপেক্ষা ছাগলের রোগ-ব্যাধি কম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ছাগলের বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে কৃমি, উকুন, নিউমোনিয়া, পাতলা পায়খানা, আমাশয়, পেট ফাঁপা, মূত্রনালিতে পাথর, পিপিআর, গোটপক্স, চর্মরোগ (মেইজ), ছাগলের ক্ষুরা রোগ, চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস এবং একথাইমা রোগ অন্যতম। নিম্নে ছাগলের পিপিআর ও গোটপক্স রোগের লক্ষণ ও তার প্রতিকার প্রদত্ত হলোঃ

পিপিআর রোগের লক্ষণগুলোঃ

এটি ভাইরাসঘটিত একটি রোগ, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম দেখা যায়। হঠাৎ ছাগলের শরীরের তাপ বেড়ে যায় (১০৪ ডিগ্রি থেকে ১০৫ ডিগ্রি) ও ক্ষুধামন্দা দেখা যায় এবং কাশতে থাকে। মুখের লালা ঝিল্লিতে রক্ত জমে লাল দেখা যায় এবং নাক দিয়ে সর্দি ও পানি ঝরে। নাকের ছিদ্রের পর্দায় ঘা দেখা যায় ও চোখে পিচুটি হয়, অনেক সময় চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। রোগ শুরুর ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই ছাগল মারা যায়।

প্রতিরোধঃ

আক্রান্ত ছাগলকে বের করবেন না। ছাগল সুস্থ অবস্থায় টিকা দিয়ে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ছয় মাস বয়সের ছাগলকে ১সিসি টিকা চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হবে।

গোটপক্স রোগের লক্ষণগুলোঃ

মুখের চারপাশে, মুখগহ্বরে, কানে, গলদেশে, দুধের বাঁটে এবং পায়ুপথে বসন্তের গুটি দেখা যায়। দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, কিছু খায় না, জাবর কাটে না এবং ছাগলের পাতলা পায়খানা হয়।

প্রতিরোধ :

এই রোগ হলে অন্যান্য সুস্থ ছাগলকে এন্টিপক্সসিরাম ইনজেকশন ও টিকা সহজলভ্য হলে টিকা দিতে হবে। আক্রান্ত ছাগল বিক্রি করা উচিত নয়। পাল থেকে আক্রান্ত ছাগল সরিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে।

লেখক : প্রোগ্রাম অফিসার (কৃষি), ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, ঢাকা

আপনার কৃষি সহায়তা আপনার এলাকাতেই।
কৃষি, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি, গবাদি পশু পালন, এবং পশু পাখির প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কিত যত তথ্য, জিজ্ঞাসা, কখন কোথায় কি হচ্ছে, কোন ঋতুতে কি ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব, কি কি ধরনের পূর্ব সতর্কতা নিতে হবে প্রভৃতি সকল বিষয়ে আমারা চেষ্টা করব আপনাদের জানাতে। আপনারাও পছন্দ মত বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন। আমরা চেষ্টা করব স্থানীয় ভাবে বিশেষজ্ঞ সহায়তা প্রদান করতে।
আপনাদের একজনের অংশগ্রহণই হয়ত অন্যজনকে সাহায্য করবে কৃষি সফল খামারি হতে।
ধন্যবাদ